
৭৪ বছর ধরে দু'দেশের মানুষের একটাই আশা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এক হবে!
উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া এক সময় একটি দেশ ছিল। এরপর একটি বিবাদের কারণে দুটো দেশের মধ্যে ফাটল তৈরি হয় এবং নতুন দুটি দেশের উৎপত্তি হয়। দুটো দেশের শাসকদের মধ্যে আদর্শগত বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। দুটো দেশ আলাদা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৭৪ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব রয়েছে যার জন্য হয়তো দু দেশের জনগণ এক হতে চেয়েও এক হতে পারছেন না। যাই হোক আমরা আজ জানব দক্ষিণ এবং উত্তর কোরিয়া একটি অন্যটির চেয়ে কতটা আলাদা? যদিও দুই দেশের জনগণ মনে করেন যে দুটো দেশের মানুষের আচার এবং সংস্কৃতি একই ধরনের কিন্তু বাস্তবে ঠিক তার উল্টো।দু দেশের জনগণের মনের দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ভবিষ্যতে দুই কোরিয়া এক হবে, থাকবে না কোন সীমানা কিংবা রাষ্ট্রীয় বাঁধা নিষেধ।
দুটো দেশ কিভাবে আলাদা হয়েছিল?
Internet
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন জাপানের আত্মসমর্পণ করাটা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে পড়ে, একটা প্রশ্ন তখন খুব বেশি শোনা যাচ্ছিল যে, কোরিয়ার কি হবে? দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কোরিয়া উপদ্বীপ জাপানের দখলে ছিল পরবর্তীতে জাপান সেখান থেকে সরে যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে ৩৮ তম সমাক্ষরেখা অনুযায়ী কোরিয়াকে ভাগ করতে সম্মত হয়। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণাঞ্চলের দখলদারিত্ব নিয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়েছিল উত্তরাঞ্চলের। এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল জাপানের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে করিয়ান মানুষের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করা। ১৯৪৮ সালে দুটো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বেশ কয়েকবার ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু দুটো দেশের মধ্যে কমেই আদর্শগত বিভেদ প্রবল হতে থাকে যার ফলে দুটো দেশের লোক সারা জীবনের জন্য আলাদা হয়ে যায়।
১. দুটো দেশ, একটি জনগোষ্ঠী- কিন্তু শান্তি নেই
www.dw.com
৬০ বছরের ও বেশি সময় আগে কোরিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে কোন দাপ্তরিক শান্তি নেই। দুটো দেশের লোকজন "Demilitarized Zone -DMZ" বা "অসামরিক এলাকা" নামক একটি সীমানা দিয়ে বিভক্ত হয়েছে যা পৃথিবীর অন্যতম অস্ত্রসজ্জিত সীমানা প্রাচীর যেখানে ৮০ কিলোমিটার অংশজুড়ে ৭,৭০,০০০ হাজার উত্তর কোরিয়ার সৈন্য বিপরীতে দক্ষিণ কোরিয়ার ৬,০০,০০০ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ২৮,৫০০ জন সৈন্য সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে।
২. বিভাজন
www.dw.com
উত্তর কোরিয়া বিভাজন এর শুরু থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন এর সমর্থন পুষ্ট একটি সাম্যবাদী দেশ, কিন্তু পরবর্তী সময় কালে উত্তর কোরিয়ার সরকার তাঁদের রাষ্ট্রনীতিতে সাম্যবাদের অবসান ঘটিয়ে সামরিক এবং আত্মনির্ভর নীতিতে চলছে যেখানে কিম সাম্রাজ্য এককভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।
৩. পরিবারের বিচ্যুতি
দুই বোন যখন ৬৫ বছর পর মিলিত হলেন
দুটো দেশের বিভাজনের পর থেকে অনেক পরিবারকেই তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক আলাদা হয়ে যেতে হয়েছিল। ৭০ বছরের ব্যবধানে সে সকল বিতাড়িত পরিবারগুলোর অনেকের মধ্যেই যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখনো ৭০,০০০ লোকজন সরকারি সমর্থনে আলাদা হওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে পুনর্মিলনের অংশগ্রহণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
৪.মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাম্রাজ্য
www.thoughtco.com
জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষকগণ উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র সমালোচনা করেছেন। উত্তর কোরিয়াতে গণগ্রেফতার, হত্যা এবং দাসে রূপান্তর করণ ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন দেশটি দাবী করে যে তাদের নাগরিকরা সত্যিকারের মানবাধিকার উপভোগ করছেন। তারা তাদের এই অপকর্ম ঢাকতে গিয়ে দাবি করেন কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির অধিকারের কথা চিন্তা করে আমরা সামগ্রিক অধিকার কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারি না।
৫. পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন
teamyello.files.wordpress.com
উত্তর কোরিয়া তে সকল ধরনের সংবাদমাধ্যমকে সরকারের পক্ষ থেকে নিবিড় নিয়ন্ত্রণে রাখা হয় এবং উত্তর কোরিয়ার বাইরের যে কোন ধরনের বিদেশী বই গান কিংবা কোন ধরনের সম্প্রচার পড়া, শোনা কিংবা দেখা পুরোপুরি নিষিদ্ধ এ জন্য নির্ধারিত সাজার ব্যবস্থা রয়েছে। মানুষের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি একদমই সংকীর্ণ ধারণা রয়েছে। ২০০৯ সালে কিম জং ইল সেখানে হ্যামবার্গার আবিষ্কার করেন।
৬. পুরো দেশ ভুগছে
leeherald.com
যেখানে দক্ষিণ কোরিয়া তাদেরকে একটা প্রযুক্তিগত মহা শক্তিশালী দেশ হিসেবে সমৃদ্ধ করছে অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার তার নাগরিকদের সামান্য মৌলিক খাদ্য সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে উত্তর কোরিয়ার ৫ বছরের নিচের প্রতি পাঁচজন বাচ্চার একজনের দীর্ঘস্থায়ী পুষ্টিহীনতার উপসর্গ রয়েছে।
৭. ভৌগোলিক আয়তন ও অন্যান্য
News at noon
ক্ষুদ্র ভৌগোলিক আয়তন থাকা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়ার চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। উত্তর কোরিয়াতে জনসংখ্যা ২৫ মিলিয়ন যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা ৪৯ মিলিয়ন। উত্তর কোরিয়াতেকম্পোস্ট সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণের ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার লোকজনের চেয়ে উত্তর কোরিয়ার লোকজন এর উচ্চতা যথেষ্ট কম। বিদ্যালয়মুখী ছাত্র ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টা যথেষ্ট দৃশ্যমান। সিওলে অবস্থিত সাংকিকিউন নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যানিয়েল এর গবেষণা অনুযায়ী প্রাক প্রাথমিক বালকদের উচ্চতার পার্থক্য ১.৬ ইঞ্চি এবং মেয়েদের ১.২ ইঞ্চি। মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার বাচ্চাদের উচ্চতা উত্তর কোরিয়ার বাচ্চাদের চাইতে বেশি। দুটো দেশের মানুষের আয়ুষ্কালেও যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। উত্তর কোরিয়ার মানুষের গড় আয়ু ৬৯ যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের ৭৯। তবে আত্মহত্যার হার এ ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১২ সালে ১৪১৬০ টি আত্মহত্যার ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘটে। যেখানে উত্তর কোরিয়ার বন্দিশালা গুলোতে তেমন কোন আত্মহত্যার ঘটনাই ঘটে না। অথচ দক্ষিণ কোরিয়াতে গড়ে প্রতিদিন ৩৯ জন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যদিও তাদের গণতন্ত্র থেকে শুরু করে সকল ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তারা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে।
৮. ধর্ম
সাম্যবাদের নীতিতে বিশ্বাস করা কারণে উত্তর কোরিয়া প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নাস্তিক দেশ। অন্যদিকে বেশ কয়েক দশক ধরে দক্ষিণ কোরিয়াতে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়াতে নাগরিকদের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা পুরোপুরি উন্মুক্ত। ২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ১০০ জন মানুষের মধ্যে ৮১ জনি অনলাইনে ছিল। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া তে শুধুমাত্র সরকারি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন তবে শুধুমাত্র কঠোর নিয়ন্ত্রণ এর মধ্য দিয়ে। উত্তর কোরিয়া তে নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা রয়েছে যার নাম কুয়াংমিয়ং। মজার বিষয় হচ্ছে এটা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের সাথে সংযুক্ত নয় শুধুমাত্র তাদের দেশের অভ্যন্তরেই এটি প্রচলিত রয়েছে। তবে সেখানে ঢুকে মানুষ আসলে কি ব্রাউজ করে সেটা জানার আগ্রহ অনেকেরই রয়েছে? আসলে সেখানে সম্পূর্ণ কিম সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে সেখানকার শাসকদলের তথ্যে ভরপুর। এছাড়া অন্য কিছু সেখানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না।
৯. ভবিষ্যতের আশা ও প্রত্যাশা
cdn.vox-cdn.com
দুটো দেশের মধ্যে দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয়ে বিভেদ থাকলেও, অনেক দক্ষিণ কোরিয়ার লোকজনের সাথে কথা বলে এটা স্পষ্ট জানা যায় যে, তাদের মধ্যে এ ধরনের আশা কিংবা প্রত্যাশা রয়েছে যে একদিন হয়ত দুটো দেশ পুনরায় এক হবে। আমরা এই প্রত্যাশা রাখি যে, দু দেশের মধ্যে কোন একদিন সম্মিলন হবে। মানুষের মনের ক্ষোভ কিংবা ঘৃণার অবসান ঘটবে, যদিও দু দেশের মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব আসলে রাষ্ট্রীয়।
আমাদের আয়োজন কেমন লাগলো বন্ধুরা? যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।সঙ্গে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ...